একসময় চট্টগ্রামবাসী স্বপ্ন দেখতো যদি কর্নফুলী নদীর নীচ দিয়ে একটি টানেল হতো তাহলে কতই না সুখের হতো, আনন্দের হতো, কয়েক মিনিটেই নদীর তলদেশ দিয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে নদীর অপর পাড়ে আনোয়ারা উপজেলায় পৌঁছে যাওয়া যেতো। তবে চট্টগ্রামবাসীর জন্য এ দাবি সর্বপ্রথম তুলেছিলেন চট্টগ্রামের গনমানুষের নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। সেই কর্নফুলী নদীর নীচ দিয়ে অবশেষে কিন্তু টানেল হয়েই গেলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক সদিচ্ছায় সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়েছে।
আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে চট্টগ্রামে উপস্থিত থেকে এই টানেলের উদ্বোধন করবেন। তিনি নিজেই একের পর এক ইতিহাস গড়ছেন বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশেই নয়। দক্ষিণ এশিয়া এমনকি অনেক সময় সারা পৃথিবীতেও। যেমনটি তিনি করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের নিজের টাকায় পদ্মাসেতু তৈরি করে। আর চট্টগ্রামে কর্নফুলী নদীর নিচ দিয়ে অনেকটা কম সময়ের মধ্যেই তার নির্দেশনায় তৈরি হয়ে গেলো এই টানেল।
আগামী অক্টোবরের ২৮ তারিখ খুলছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল। উদ্বােধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) এক টেবিলে বসেছিলেন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও চট্টগ্রামের প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতারা। ওইদিন জনসভার পাশাপাশি টানেল উদ্বােধন ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তারা বললেন, দেশের অগ্রযাত্রা ও সক্ষমতার পালকে যুক্ত হতে যাচ্ছে আরেকটি মাত্রা। উদ্বােধনের পরে টানেলে যানবাহনের চলাচলের সীমাবদ্ধতা, গতি নির্ধারণসহ ব্যবস্থাপনার নানা বিষয় উঠে আসে বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ জানালেন, টানেলে এর মধ্যে কয়েক দফা ট্রায়াল রান সম্পন্ন করা হয়েছে। উদ্বােধনের আগেই আরেকবার ফাইনাল ট্রায়াল দিতে চান তারা। ২৮ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর উদ্বােধনের পর ২৯ তারিখ সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেয়া হবে এই টানেল। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চায় প্রশাসন। সে অনুযায়ী চলছে প্রস্তুতি।
এমনটাই বললেন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন। কর্ণফুলী টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত পড়েছে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলায় এবং সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব জেলা পুলিশের। বৈঠকে উপস্থিত জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ। আনোয়ারা প্রান্তে এপ্রোচ সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশ ক্যাম্প করার পাশাপাশি নেয়া হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমনটাই জানান তিনি।
আগামী ২৮ অক্টোবর আনোয়ারা প্রান্তে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জনসভারও আয়োজন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে এটি অনেকটা আগাম নির্বাচনী জনসভাও হতে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকেও নেওয়ার দরকার নেই। জেলা প্রশাসন উদ্যেগ নিতে পারে। এতে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। টানেলে গতকয়েক মাস ধরে ট্রায়াল হচ্ছে। ইলেকট্রিক মেকানিক্যাল কাজ হয়ে যাওয়ার পর প্রি কমিশনিং, সেইফটি এসবই ট্রায়ালের অংশ।
এর আগে টানেলের উদ্বোধনীর প্রস্তুতিমুলক সভায় এই কর্মকর্তা বলেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের টানেলের কাজ সমাপ্তি করার কথা থাকলেও তার আগেই আমরা কাজ শেষ করেছি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) এখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। দিনশেষে আমরা সবাই কাজ করছি দেশের জন্য, জাতির জন্য। সবাই মিলে কাজ করলে কোনো সমস্যা হবে না।
এখানে একটি মজার বিষয় হচ্ছে টানেলে ঢুকার আগে যেসব গাড়ি এফএম রেডিও চালু করবে তখন টানেল ব্যবহারের নীতিমালা অটোমেটিক চলতে থাকবে। অধিকাংশ রেডিও স্টেশনে এই নীতিমালা রয়েছে। টানেলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেডিওতে এই নীতিমালাগুলো পড়ে শুনানো হবে।
মনজুর হোসেন আরও বলেন, ২৯ অক্টোবরের আগে টানেলে সাধারণ মানুষ কেউ যেতে পারবে না। ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল উদ্বোধনের করার পরদিন ২৯ অক্টোবর সকাল ১০টার পর টানেল সাধারণ মানুষের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হবে। ইমার্জেন্সী গাড়ি ও প্রশাসনের অন-ডিউটিরত গাড়িকে টোলের আওতায় আনা হবে না। আর সবাইকে টোল দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও টোল দেন। যেসব জায়গায় যেতে উনাকে সেতু ব্যবহার করতে হয়েছে সব জায়গায় উনাকে পুরো গাড়ির বহরের জন্য টোল দিতে হয়েছে সভায় আরও বক্তব্য দেন বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়, ডিআইজি নুরে আলম মিনা, পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, টানেলর প্রকল্প পরিচালক হারুন উর রশিদ ও আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম।
সেতু সম্পর্কিত তথ্য: ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর বঙ্গবন্ধু টানেল কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই টানেলের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। এটা বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এই সুড়ঙ্গ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। সর্বশেষ সংশোধিত বাজেটে, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এছাড়া, নির্মাণ ব্যয়ও ১৬৪ কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়